নদীবোধ
বৃন্তমুল দিয়ে বোনা তিনটে শালপাতা
তার উপর সিন্দুর, আকন্দ ফুল আর চন্দন
মাটির প্রদীপে তেল, পলতের মুখে আলো । ভাসিয়ে দিলাম ।
বরফ-নীল গর্ভের উষ্ণতায় জন্মেছে যে জল
ঘাটে ঘাটে ছোঁয় তার স্রোতের রোশনাই,
স্রোত নিয়ে যায় করতালুর উত্তাপ । হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে নিই আত্মন ।
দশাশ্বমেধ বেয়ে জন্ম সুতো মনিকর্নিকা ঘাটে আসে
মাঝে জমাটবাধা শহরতলিতে তখন ভর-সন্ধ্যে
শেষ আরতি আবর্তে মন্দিরে চাবি দেন অহল্যাবাঈ
আলো নেভে ‘ফেয়ার এন্ড লাভলী’র হোর্ডিংয়ে
বায়স্কোপ ফেরত ছোকরার মুখে চলতি গানের কলি
‘এ লাল রাঙ কব্ মুঝে.. ’
দূরে বেজে ওঠে এস্রাজ, অশরীরী বাঈজীর ঘুঙুর ।
সস্তা হোটেল । কাটা শিরা ।
বাথটবে রঙিন ঘূর্ণি । সেখানেই বইছে আমার নদীবোধ ।
মেরু
জানি তুমি আছো উত্তরে কোথাও
আর আমি, বোধহয় দক্ষিণামন
আমাদের এই দূরত্বভার
বয় ভিজে মাটির বাষ্প,
আর কিছুটা দেওয়াল লিখন।
সমুদ্রগর্ভ থেকে জেগে ওঠে আরাবল্লীর শ্যামল
ফসিলের ছাঁচে নেমে যায় অসংখ্য ছায়াবিকেল
হয়তো এই বিপণন আবহমান,
তবুও আমি দাঁড়িয়ে দেখি ..
আমাদের বলরেখা ধরে
তোমাকে আমার বিধ্বস্ত ঝড়ের খবর পাঠায়
ভাসমান খড়কুটো,
ছেঁড়া ছেঁড়া প্রাগৈতিহাসিক কোনো অভিমান..
পর্ণমোচী
স্টেশনচত্বর জমজমাট হয়ে আসছে,
তিন নম্বর প্লাটফর্মে হাওড়া লোকাল, চারে শেওড়াফুলি
ব্যস্ত মানুষের ছোটাছুটি, রুমাল ছুঁড়ে সিট্ দখল।
ম্যাগাজিন স্টল ঘিরে উৎসাহী চোখ
ক্রিকেট স্কোর, স্টারডাস্ট আর রাজনীতি।
ফত্ ফত্ করছে কয়েক পাতা ফ্যাকাশে লটারির টিকিট ।
পানমসলা, গুটকার ফেরিওয়ালা,
প্রয়োজনে পাওয়া যাবে পকেটে লোকানো গোল্ডফ্লেক,
চটপট বিক্রি হয়ে যাচ্ছে লেবু-চা, মসলামুড়ি, সিদ্ধ-ডিম্ ।
ধাতুর পাত্রে জিওল মাছের ছটফটানি,
নিশ্চিত অনিশ্চিতে পাথর চাপা ছপাৎ ছপাৎ ইচ্ছে-পাখনা।
ওভারব্রিজ থেকে নেমে আসছে এক ঝাঁক তরুণ-তরুণী
রকমারি ব্যাগ, রোদ চশমা, সাদা-নীল স্কুল-পড়ুয়া কজন,
টিফিন-বাক্স, জলের বোতল, রামধনু-ছাতা ।
আর সময় নেই, ঘন ঘন ঘড়ি দেখছি,
লাল, হলদে, সবুজ সব রং গুঁতোগুঁতি করে মিশতে চাইছে,
দোনোমোনায় ছেড়ে দিলো ট্রেন, চেনা কেউ পৌঁছালো না এখনো।
একটা নিঃসঙ্গ নিস্তব্ধতা দানা বাঁধছিলো চারিদিকে,
হঠাৎ, একটা বিকট হর্ন
এক নম্বর প্লাটফর্মকে পাশ কাটিয়ে
এক নিমেষে দানবের মতো ছুটে গেলো শতাব্দী এক্সপ্রেস
ঝুরঝুরে চুন-সুরকির সাথে উড়ে গেলো কটা শালিখ ।
মাটির গভীরে কেঁপে উঠলো নিখোঁজ বিপ্লবীদের হাড়-কঙ্কাল।