পুতুলনাচ
সকাল হয়ে আসছে। অন্ধকার কাটছে। আস্তে আস্তে সব কিছু দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। বাড়িঘর, গাছপালা, রাস্তাঘাট। অপরিচ্ছন্ন দৃষ্টি পরিচ্ছন্ন হচ্ছে। সূর্য আর একটু পরেই উঁকি দেবে। ব্যস, সব কিছুর ওপর সেই আলো এসে পড়বে। আর কিছুই লুকিয়ে রাখা যাবে না। ওই তো ঘরের বড় খাটের ওপর নক্সাকাটা চাদরে মোড়া নরম গদিতে মাথায় এবং পায়ে বালিশ শোভিত হয়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে খ-বাবু। মাথার ওপর ঘুরছে ফ্যান। গরমে হাঁসফাঁস করতে করতে কোন সময় চ-রানি মশারিটা খুলে দিয়েছে। চ আগেই বিছানা ছেড়েছে। ইতিমধ্যে সূর্য একটু প্রকট। জানালা দিয়ে খ-বাবুর ছড়ানো পা-টাকে সূর্যের আলো ছুঁয়ে ফেলেছে। খ ছড়ানো পা গুটিয়ে নিল। জানালার দিকে একবার একচোখে তাকিয়ে নিয়ে ফের চোখ বুজল। চ ঘরে ঢুকল। হাতে চায়ের কাপ। ছোট্ট বেডসাইড টেবলটা বিছানার কাছে টেনে চায়ের কাপ তার ওপরে রাখল। বাঁহাত দিয়ে খ- এর চুলে একটু বিলি কেটে দিয়ে বলল, চাটা খেয়ে উঠে পড়। একটু পরেই হাঁক দেবে সবজি বলে। হ্যাঁ, আজ যেন মাস্কটা পরতে ভুল না হয়। খ কোন সময় চ- এর হাতটা ধরে ফেলেছে। চ হাত ছাড়িয়ে বেরিয়ে গেল। বলল, আমার তাড়া আছে।
সাদা হুলোটা ঢাকা বারান্দায় রাখা পাপোষের ওপর শুয়ে। ওখানটা একটু অন্ধকার মতো। পাশের দরজা দিয়ে একটুখানি রোদ ঢোকে। কিন্তু তার দেরি আছে। হুলোর ঘুম ভেঙেছে। এদিক ওদিক দেখে নিল সে। গা ভাঙল। বুক ডন দেওয়ার মতো ভঙ্গি করল। খ ওর সামনে থিন অ্যারারুটের একটুখানি ভাঙা ছুড়ে দিয়েছে। ও এখনও ছুঁয়ে দেখেনি। অত তাড়াহুড়ো কিসের! ছাই ছাই রঙের মেনি দরজা দিয়ে গুটি গুটি পায়ে ঘরে ঢুকল। মুখে যেন কী। চ দেখেও না দেখার ভান করল। হুলোর পাশে মেনি ওটা রাখল। বলল, মিউ। মানে নাও। হুলো বিস্কুটের টুকরো ছেড়ে ওটার দিকে মনোনিবেশ করল। মেনি বিস্কুটটার সদ্ব্যবহার করল।
দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে উঠোনে একটা আমগাছ। খুব বড় নয়, মাঝারি আকার। সূর্যের আলো গাছের পাতায় পাতায় খেলছে। একটা ডালে একটা কাক বসে। ওরা অনেক আগে উঠে পড়ে। ঘুমিয়ে পড়েও সাত তাড়াতাড়ি। কাকিনী কোথা থেকে যেন ফিরল। কাকের একেবারে পাশে বসল। মুখের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে কী যেন বলল। হয়ত বলল, কী ভাবছ গো? নিশ্চয়ই আমার কথা। কাকও মনে হল কিছু বলল। সে হয়তো বলল, তোমার কথা ভাবতেই হবে! না, তোমার কথা আমি ভাবিনি। ফালতু কথা ছাড়। বাজারে মিষ্টির দোকানি দোকানের টিনের চালে বাসি বোঁদে ছুড়ে দেবে। ভুলে গেলে নাকি? চল, দেরি হয়ে গেল বোধ হয়। দুজনে উড়ে গেল।
আর একটা দিন শুরু হবে। অন্ধকার কাটতে শুরু করেছে। একটু একটু করে সব কিছু দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। সূর্যও উঠব উঠব করছে। পুব আকাশ একটু লাল হয়েছে। দেখা যাচ্ছে খ-বাবু আর চ-রানির শোয়ার
ঘরের জানলা। জানলা দিয়ে উঁকি দিলে সেই বিছানা, সেই নরম গদি, সেই বালিশ। আর সেখানে আরামে ঘুমিয়ে আছে কে? আমগাছের কাক। এখন আর সাত তাড়াতাড়ি ঘুম ভাঙে না। সাত তাড়াতাড়ি ঘুমিয়েও পড়ে না। তবে কাকিনীর ঘুম আগেই ভেঙেছে। সে এক্ষুনি জানলা দিয়ে ঢুকে খাটের ছতরিতে বসল। কাকের দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে ডাকল, কক্। মানে ওঠো গো। কাক ঝটপট করে পাখা ঝাপটে উঠে পড়ল। কউ কাউ কা করে বলল, অ্যালার্ম দিয়ে রাখা উচিত ছিল। খুব ভুল করেছ। বাজারে মিষ্টির দোকানি আমাদের জন্যে অপেক্ষা করলে হয়! ওরা দুজনে ডানা ঝাপটা দিয়ে জানলা গলে বেরিয়ে গেল।
ঢাকা বারান্দায় এখনও রোদ আসেনি। তাই এখনও ঘুমিয়ে খ-বাবু। অল্প অল্প নাকও ডাকছে। এটাই ওদের শয়নস্থান। পাপোষে গা এলিয়ে দিয়ে শুয়ে আছে খ। চ আগেই উঠে গেছে। চায়ের কাপ হাতে চ এল। খ- এর মাথার গোড়ায় ঠক করে কাপটা নামিয়ে দিয়ে চ বলল, এত ঘুম কিসের! উঠে চা খেয়ে সবজি টবজি এনে আমায় উদ্ধার করো। খ তড়াক করে উঠে পড়ল। চায়ের কাপে শব্দ করে ক’বার চুমুক দিল। বারমুডার পকেট থেকে একটা বিড়ি আর দেশলাই বার করে বিড়িটা ধরিয়ে নিল। তারপর বিড়ি সহযোগে তারিয়ে তারিয়ে চা-টা শেষ করল। বাথরুম থেকে ঘুরে এসে থলে টলে নিয়ে সে দৌড়ে চলল সবজি আনতে।
এখন সূর্য পুরোপুরি উঠে গেছে। উঠোনে আমগাছটাও নবীন সূর্যের কাঁচা রোদে ভরে গেছে। হুলো সাইকেল চালানোর ভঙ্গিতে একটা ডালে শুয়ে। চোখ তার বোজা। তার মাথায় রোদ লাগছে। ঘুম তার ভাঙল বলে। মেনির ঘুম আগেই ভেঙে গেছে। সে গাছ থেকে নেমে বাইরে বেরিয়েছিল। গাছের গোড়া থেকে ওপরের ডালে ঘুমন্ত হুলোর দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বলল, মিউ। সেই ডাক হুলোর কানে গেল না। মেনি তড়াক করে গুঁড়ি বেয়ে গাছে উঠে পড়ল। তারপর হুলোর কাছে গিয়ে অনেকবার মিউ মিউ করল। হুলো চোখ মেলল। শুনল বোসবাড়ির বড়ছেলের ছেলের মুখে ভাতে বড় বড় মাছ আনার কথা। তার জিবে জল এল। একলাফে হুলো নীচে নামল। একটু ব্যায়াম করে নিল। তারপর দুজনে বেরিয়ে গেল।
মানুষ শোয় বিছানায়। সেই বিছানায় শুয়ে আছে কাক। রাতে হুলো আর মেনিবেড়াল ঘুম দেয় আমগাছের ডালে। আর মানুষ শুয়ে থাকে ঢাকা বারান্দায় পাপোষের ওপর। অথচ কাকের ডানাদুটো হাত হয়ে যায়নি। বেড়ালের সামনের দুই পা ডানা হয়নি। মানুষ চার পায়ে হাঁটে না। সূর্য যেমন ওঠে, যেমন ডোবে, তেমনই উঠছে, তেমনই ডুবছে। নদী তার গতিপথ ধরেই ছুটে চলেছে সাগরের দিকে। রাস্তা ধরে চলছে পথিক, যানবাহন। দিনে আলো আর রাতে অন্ধকার। সবই যখন ঠিক আছে, তাহলে এই ব্যতিক্রম কেন? আসলে সবার ওপরে বিরাজ করেন এক মহাকবি। পৃথিবীর সব শিল্প, সব সৃষ্টিকে তিনি নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনি দেখতে চেয়েছিলেন ওই ব্যতিক্রমী দৃশ্যমালা। তিনি পরীক্ষক, তিনি গবেষকও। তিনি যদি মনে করেন, তাহলে বেড়াল, কুকুর, হরিণ, বাঘেরা ডানা মেলে উড়ে যাবে। কাক, কোকিল শালিখ, ময়ূরদের ডানার জায়গায় দুটো হাত গজিয়ে উঠবে। আর মানুষেরা চারপায়ে হেঁটে শ্বশুরবাড়ি বাজার অফিস ইসকুল কলেজে যাবে। তখন তিনি
আমার বা আমার মতো আর কারও হাত দিয়ে তা লিখিয়ে নেবেন। আমি আমরা তা লিখে যাব। তিনি আমাদের নিয়ে পুতুল খেলছেন। যেমন করান, তেমনি করি। যেমন নাচান, তেমনি নাচি।
গল্পের কাঠামো ও বিষয় বেশ সুন্দর। বলার ভঙ্গী ভালো। তবে সৃষ্টিকর্তার বিষয় নিজস্ব দশর্নের । সেখানে শুধুমাত্র প্রকৃতিও হতে পারে।